কে এম শাহীন রেজা, কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি:
জাসদ গণবাহিনীর আদলে নিজ নামে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ অঞ্চলে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে কুষ্টিয়া ইবি থানার আব্দালপুর গ্রামের কালু। একের পর এক হত্যা, হাট-ঘাট দখল এবং অবৈধ অস্ত্র ও দলে নতুন নতুন ক্যাডার ভিড়িয়ে সে গড়ে তুলেছে নিজস্ব সাম্রাজ্য। নিষিদ্ধ অন্ধকারের এ বাহিনীর ভান্ডার রক্ষক, দিনের আলোয় ঘুরে বেড়ানো রাজুকে আটক করেছে ইবি থানা পুলিশ। গত ২৩ জুন রাতে চরমপন্থী সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর প্রধান কালুর সেকেন্ড ইন কমান্ড রাজু আহমেদকে পশ্চিম আব্দালপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) থানা পুলিশ। আটক রাজু আহমেদ কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পশ্চিম আব্দালপুর গ্রামের রিয়াজুল ইসলামের ছেলে ও শীর্ষ সন্ত্রাসী কালুর চাচাতো ভাই। সম্প্রতি ইবি থানার মধুপুরে গুলিত নিহত টুটুল হত্যাকাণ্ডে তাকে আসামি করে গতকাল জেলখানায় পাঠানো হয়েছে।
আদালতে দাখিলকৃত পুলিশ প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জানা যায়, ইবি থানা পুলিশের হাতে আটক আসামী রাজু আহমেদ চরমপন্থী সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর প্রধান কালুর সেকেন্ড ইন কমান্ড। কুষ্টিয়া জেলাসহ ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, রাজবাড়ী, পাবনা, নাটোর এলাকার অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী এই কালু। কালুর একাধিক নাম, বড় কালু ওরফে আলী রেজা ওরফে বুলবুল ওরফে কমল দা। কালু একাধিক মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী। তিনি বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে পলাতক থেকে তার বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হাট-ঘাট ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে আধিপত্য বিস্তার, বিরোধীতা করলে গুলি করে হত্যা, খুনের পর স্বীকারোক্তি দিয়ে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে কালু বাহিনী। উল্লেখিত অঞ্চল সমূহের হাট-বাজার, বালু মহল, পদ্মা ও গড়াই নদীর চর দখল এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মাঠ পর্যায়ে আসামী রাজু তার সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে কাজ করছে। রাজু প্রতিদিন একাধিক বার অডিও/ভিডিও কলে তার কথা বলে মাঠ পর্যায়ের সার্বিক অবস্থা তাকে জানান এবং বিভিন্ন হাট, বাজার, বালুর ঘাট, টেন্ডার ইত্যাদি থেকে আদায়কৃত অর্থের নির্দিষ্ট অংশ কালুকে প্রেরন করে। গত ৬ জুন কুষ্টিয়া ইবি থানার দুর্বাচারা গ্রাম থেকে সেনা বাহিনী অভিযান চালিয়ে আলোচিত সন্ত্রাসী জাহাঙ্গীর কবির লিপটনকে তিন সহযোগিসহ আটক করে। সে সময় তাদের নিকট থেকে ৫টি অবৈধ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে। কালু ও লিপটন দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ নেতাদের ছত্রছায়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা কিছুদিন গা ঢাকা দেয়। কিছু দিন পরই তারা আবার বিএনপি নেতাদের আনুকল্য নিয়ে নানা অপকর্ম শুরু করে।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ত্রিবেনী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর শ্মশানঘাট এলাকার একটি ক্যানালের পাশ থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ, নিহতদের মাথায় গুলির চিহ্ন ছিল। ঐ সময় হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় দাবি করা হয় ‘এতদ্বারা ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনাবাসীর উদ্দেশ্যে জানানো যাইতেছে যে, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী কুখ্যাত ডাকাত বাহিনীর শীর্ষ নেতা অসংখ্য খুন, গুম, দখলদারি, ডাকাতি, ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হরিনাকুন্ডু নিবাসী মো. হানিফ তার দুই সহযোগীসহ জাসদ গণবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন। তাদের লাশ রামচন্দ্রপুর ও পিয়ারপুর ক্যানালের পাশে রাখা আছে। অত্র অঞ্চলের হানিফের সহযোগীদের শুধরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো অন্যথায় আপনাদের একই পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। কালু জাসদ গণবাহিনী।’ এ ঘটনার পর থেকেই কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ এলাকায় আতঙ্ক ও ভয় ছড়াতে থাকে। কালু ও লিপটন নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও এলাকায় ভয় ছড়িয়ে দিতে এ হত্যাকাণ্ড চালিয়ে তা আবার জানিয়ে দেয়। এর পর থেকে এলাকার হাট-ঘাট ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রনে একক আধিপত্য দেখাতে থাকে কালু ও লিপটন বাহিনী। নির্দেশ না মেনে মধুপুর কলার হাট ডেকে নেওয়ায় গত ১১ জুন মধুপুর ইটভাটা বাজারে সন্ধ্যার পরে গুলি করে হত্যা করা হয় মুদি দোকানী ও হাটে অর্থলগ্নীকার টুটুল হোসেনকে। এর পর ১৫ জুন ইবি থানার আব্দালপুর গ্রামের এক ব্যবসায়ী ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা, দুদিন পরে অপহৃত জাহাবক্স নামের ঐ ব্যক্তি উদ্ধার হলেও সে ঘটনায় কালুর ভাই আব্দালপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও একই ইউপির চেয়ারম্যান আলী হায়দার ওরফে স্বপনকে পুলিশ আটক করে অপহরণ মামলায় জেলে পাঠিয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানার অফিসার ইনচার্জ মো, মেহেদী হাসান আরও বলেন, রাজুর কাছ থেকে তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন, তাকে আদালতের মাধ্যমে আরও জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ হলে কালুসহ তার অন্যান্য সহযোগীদেরও গ্রেফতার করতে সক্ষম হবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, রাজু কুষ্টিয়া জেলাসহ ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, রাজবাড়ী, পাবনা, নাটোর এলাকার অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী নেতা, জাসদ গণবাহিনীর প্রধান কালুর বিশ্বস্ত ও চাচাতো ভাই। এ বাহি-নীর দুর্র্ধষ ক্যাডার আলী রেজা, বুলবুল, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কমল দাসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। কালু দেশের বাইরে থাকলেও এসব এলাকার হাট, বাজার, বালু মহল, পদ্মা ও গড়াই নদীর চর দখল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করা হতো রাজুর মাধ্যমে। মাঠ পর্যায়ে আসামী রাজু বর্তমানে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে এলাকায় কাজ করছে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়। কালুর সঙ্গে তার প্রতিদিনই একাধিক বার অডিও/ভিডিও কলে কথা বলে মাঠ পর্যায়ের সার্বিক অবস্থা তাকে জানায় এবং বিভিন্ন হাট, বাজার, বালুর ঘাট, টেন্ডার ইত্যাদি থেকে আদায়কৃত অর্থের নির্দিষ্ট অংশ কালুকে প্রেরন করে। লিখিতভাবে ইবি থানা থেকে জানানো হয়েছে, গত ৫ আগষ্টে কুষ্টিয়া মডেল থানা হতে খোয়া খাওয়া অস্ত্র ক্রয় বিক্রয়ের ছবি/ভিডিও সে কালুকে সরবারহ করে, যার মধ্যে একটি পিস্তল যা কুষ্টিয়া সদর থানা থেকে খোয়া যাওয়া অস্ত্র বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, তদন্তের স্বার্থে এই মুহুর্তে রাজুর সার্বিক বিষয়ে আমি তেমন কোন তথ্য দিতে পারবো না, তবে তিনি নিজেই একজন কালু, একাধিক হত্যা মামলার আসামী কালু ভারতে অবস্থান করছে কিন্ত রাজু তার নাম্বার ক্লোন করে নিজেই কালু সেজে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এজাহারে উল্লেখ আছে। রাজুর স্মার্ট ফোন থেকে অনেক তথ্য পেয়েছি। এখনো সাইবার ক্রাইমে মোবাইলে তদন্তের কাজ চলছে। কুষ্টিয়া মডেল থানার লুট হওয়া অস্ত্র তারা দুই ভাই কোথায় বিক্রি করল, রাজুর সাথে কার কার সম্পর্ক আছে তা উদঘাটন জরুরী এবং রিমান্ডের মাধ্যমে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করেই আমরা আপনাদেরকে জানাবো।