নিজস্ব প্রতিনিধি:
মেহেরপুরের অলিগলি জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ছোট-বড় বেকারি। এখান থেকেই প্রতিদিন তৈরি হয়ে বাজারে যাচ্ছে শিশু ও পরিবারের প্রাতঃরাশের অবিচ্ছেদ্য অংশ—বিস্কুট, কেক, পাউরুটি, চানাচুরসহ নানা রকম খাদ্যপণ্য। দেখতে আকর্ষণীয়, রঙিন মোড়কে মোড়ানো এসব পণ্যের ভেতরের বাস্তবতা কিন্তু ভয়াবহ। নোংরা, স্যাঁতসেঁতে ঘর, ধুলাবালিতে ঢাকা ট্রে, মেয়াদোত্তীর্ণ উপকরণ—এভাবেই তৈরি হচ্ছে এইসব খাবার।
গত সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন বেকারি ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ স্থানে ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। কোথাও মেঝে ভেজা ও দুর্গন্ধযুক্ত, কোথাও দেয়ালে ছত্রাক। ছারপোকায় আক্রান্ত পুরনো ট্রে ও ছেঁড়া বস্তায় রাখা হচ্ছে ময়দা। কর্মীরা কেউ খালি হাতে ময়দা মাখছেন, কেউ ঘাম ঝরানো অবস্থায় সরাসরি মিশাচ্ছেন ঘি ও ডিম। মুখে নেই মাস্ক, হাতে নেই গ্লাভস। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো—অনেক বেকারিতে ব্যবহৃত হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ ঘি, নিম্নমানের চিনি ও পচা ডিম। স্থানীয় বাজার থেকেই এসব নিম্নমানের উপকরণ কম দামে কিনে ব্যবহার করা হয় উৎপাদনে। এক বেকারির কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “গরমে কেক আর বিস্কুট দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। তখন মালিক বলেন—বেচে ফেল, ক্ষতি চলবে না।” স্থানীয় বাসিন্দা সোহেল রানা বলেন, “আমার ছেলেটা প্রায়ই বাজার থেকে বিস্কুট কিনে খায়। দুই দিন আগে খাওয়ার পর পেট ব্যথা করে। পরে বুঝলাম, হয়তো ওসব পণ্য ঠিকভাবে তৈরি হয়নি।” আরেক ভোক্তা হাসিনা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
“দেখে তো ভালোই লাগে, কিন্তু গন্ধ পেলেই বোঝা যায় পুরনো মাল। অথচ প্রতিদিনই এসব পণ্য দোকানে বিক্রি হচ্ছে।” স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, নোংরা ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে তৈরি খাবারে দ্রুত ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়। এসব ব্যাকটেরিয়া শরীরে প্রবেশ করলে হজমজনিত জটিলতা, ডায়রিয়া, চর্মরোগ, এমনকি লিভারের সমস্যাও হতে পারে। চিকিৎসক মো: শাহিনরি রশিদ বলেন, “অস্বাস্থ্যকর বেকারির পণ্য খাওয়ার কারণে শিশু ও বয়স্কদের হজমের সমস্যা ও ত্বকের রোগ বেড়েছে। আমরা প্রতিদিন এমন অনেক রোগী পাই।” জানা গেছে, মেহেরপুর শহরসহ জেলায় ১৫ টির বেশি বেকারি রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগেরই কোনো প্রকার অনুমোদন বা লাইসেন্স নেই। তবুও বছরের পর বছর তারা পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে যাচ্ছে কোনো বাধা ছাড়াই। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কিছু বেকারি মালিক নিয়মিত ‘প্রভাবশালী মহলকে’ খুশি রাখেন বলে তদারকি কর্মকর্তারা অনেক সময় অভিযানে যান না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, অনুমোদনবিহীন ও অস্বাস্থ্যকর বেকারির বিরুদ্ধে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করা হবে। মেহেরপুর স্যানিটারি ইন্সপেক্টর তরিকুল ইসলাম বলেন, “বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। জনগণের স্বাস্থ্যের প্রশ্নে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। দ্রুতই মেহেরপুর শহরের সব বেকারিতে অভিযান পরিচালনা করা হবে।” খাদ্য নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য উৎপাদন বা বিপণনের দায়ে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। তাছাড়া অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে দণ্ড দ্বিগুণ হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো—আইনের কাগুজে ধারা আর আশ্বাসের আশায় কতদিন মেহেরপুরবাসী এমন ঝুঁকিপূর্ণ খাবারের ওপর নির্ভর করে যাবে? নিয়মিত মনিটরিং, জনসচেতনতা ও কঠোর আইন প্রয়োগ ছাড়া এই বিপজ্জনক খাদ্যচক্র থেকে মুক্তি পাওয়া কতটা সম্ভব?

